Saturday, April 26, 2025

বাস্তবধর্মী কাহিনি।।

                            নীরব প্রতিবাদ

                          "আয়েশা সিদ্দীকা"


আয়েশা ছোটবেলা থেকেই নিয়ম-শৃঙ্খলায় বিশ্বাস করত। তার বাবা ছিলেন একজন পুলিশ সদস্য, যিনি শেখাতেন—“সত্য কখনও হারায় না, যদি তুমি পাশে দাঁড়াও।

এই বিশ্বাস নিয়ে সে পুলিশে যোগ দেয়। নারী হয়েও কঠোর প্রশিক্ষণ, দায়িত্ব পালন, মাঠে কাজ—সব কিছুই সাহসের সঙ্গে করে।

সহকর্মীরা তাকে শ্রদ্ধা করত, কারণ সে অন্যায়কে প্রশ্রয় দিত না।

কিন্তু সময় বদলায়, আর তার চারপাশে গড়ে ওঠে এক অদৃশ্য খাঁচা—

নিয়ম বদলে যেতে থাকে, আদেশ আসে উপরে থেকে—

“ওকে ধরা লাগবে, কারণ ও ‘ওদের’ লোক। প্রশ্ন কোরো না।”

আয়েশা বুঝে যায়—এখানে আর আইন চলে না, চলে চেনা মুখ আর দলীয় রংয়ের খেলা।তবুও সে আশা ছাড়ে না। ভেতরে প্রতিজ্ঞা করে—“যত দিন থাকি, নিজের বিশ্বাস বাঁচিয়ে রাখব।”

কিন্তু সে জানত না—এই বিশ্বাসই তাকে একদিন বন্দি করে দেবে।

একদিন থানায় একটি ধর্ষণ মামলার এফআইআর আসে।

ভিকটিম একটি স্কুলছাত্রী, আর অভিযুক্ত—স্থানীয় এক ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতার আত্মীয়।

আয়েশা নিয়ম অনুযায়ী মামলা রুজু করেন, ভিকটিমের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন এবং আসামিকে গ্রেফতার করার উদ্যোগ নেন।

কিন্তু পরদিনই তার অফিসে আসে এক “বিশেষ” ফোন।

উপরে থেকে আদেশ—“মামলাটা উঠিয়ে ফেলো। মেয়েটা হয়তো মিথ্যা বলছে।”

আয়েশা স্পষ্ট জানিয়ে দেন—

 “আমি অন্যায় চাপা দেব না। আইনের চোখে সবাই সমান।”

তারপর শুরু হয় নৃশংস খেলা—

প্রথমে বদলি আদেশ আসে, তারপর তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ,

শেষে তাকে “পারফরম্যান্স ও আচরণগত সমস্যার” অজুহাতে খুমায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

সেখানে দিনের পর দিন কোনো দায়িত্ব নেই, কোনো অস্তিত্ব নেই।

থানার ইউনিফর্ম পড়া সৎ অফিসারটি একদিন নিজের পরিচয়হীনতায় হারিয়ে যায়—

তাকে বলা হয়, “তুমি এখন শুধু ফাইল দেখবে। প্রশ্ন করবে না।”

আয়েশা জানত, তার অপরাধ একটাই—

সে ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়িয়েছে, ভুলের সঙ্গে আপোস করেনি।

এবং সেটাই তাকে পরিণত করেছে লক্ষ্যবস্তুতে।

খুলনা পুলিশ লাইনের একটি পুরনো কামরায় দিন কাটে আয়েশার।

নিয়োগপত্রে তার পদবী এস আই।অথচ বাস্তবে সে এখন এক নির্বাসিত অফিসার।

১৪ বছর—একটানা কোনো প্রমোশন নেই, পদায়ন নেই, কেবল অনন্ত অপেক্ষা।

কেউ সামনে আসলে অন্যদিকে তাকায়, যেন সে একজন অপরাধী।

তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই, নেই কোনো লিখিত অভিযোগ—

তবুও “উপযুক্ত নয়” এই ছায়া-অভিযোগ তাকে বন্দি করে রেখেছে।

প্রতিদিন সকালে ইউনিফর্ম পরে লাইন-অফ করে দাঁড়ায়,

নাম ধরে ডাকা হয় না, তাকে জিজ্ঞেসও করা হয় না কিছু।

আয়েশা ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যায় এক অদৃশ্য শৃঙ্খলের ভিতর বাঁচতে।

শুধু মাঝে মাঝে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবে—

“আমি কী আসলেই অপরাধী? না আমি কারও জন্য শুধু অস্বস্তিকর সত্য?”

তার জীবন যেন এক জীবন্ত ফাইল—খোলা নয়, কিন্তু ফেলে দেওয়া যায় না।

এভাবেই শুরু হয় আয়েশার জীবন্ত বন্দিত্ব।

যেখানে দেয়াল নেই, কিন্তু মুক্তিও নেই।

আয়েশা লক্ষ্য করে—চারপাশের মানুষগুলো বদলে গেছে।

যারা একসময় সহকর্মী ছিল, আজ তারা তাকে দেখে না, চেনে না।

তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলে না, কারণ সবাই জানে—“ওর পাশে দাঁড়ালে আমাকেও ওর জায়গায় যেতে হবে।”

এমনকি তার আত্মীয়-স্বজনও ধীরে ধীরে দূরে সরে গেছে।

তার বাড়িতে কেউ আসে না, ফোনও করে না।

সে যেন এক “বিপদজনক মানুষ”—যাকে দূরে রাখলেই নিরাপদ থাকা যায়।

তবে সমাজ শুধু চুপ নয়, মাঝে মাঝে বিষদাঁতও বের করে।

কারও মুখে শোনা যায়—

“ও বোধহয় সত্যিই কিছু করেছিল। এত বড় শাস্তি কেউ এমনি পায়?”

 “না হয় একটু ক্ষমতার বাইরে কাজ করেছে। আর কি করবে! সরকার বলে কথা!”

আয়েশা বুঝে যায়—এ সমাজে ন্যায় মানে দল, সত্য মানে সুবিধা।

যে প্রতিবাদ করে, তাকে বলা হয় ‘বেকার’, ‘বিদ্রোহী’ বা ‘রাজনীতির দালাল’।

তবুও আয়েশা বিশ্বাস হারায় না।

সে মনে মনে ভাবতে থাকে—

“একদিন কেউ তো কথা বলবে, কেউ তো দেখবে এই মুখোশের নিচের মুখ। আমি শুধু টিকে থাকব, যতদিন না সেই কেউ জেগে ওঠে।”

এক সন্ধ্যায় আয়েশা থানার পুরনো ডায়েরিগুলো খুলে বসে।

কোনো কাজ নেই, দায়িত্ব নেই—তবুও নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পেতে চায় পুরনো কাগজে।

হঠাৎ তার চোখ পড়ে একটি রিপোর্টে—এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে, কারণ তার মামলা থানায় রেকর্ড হয়নি।

তার বুক ধক করে ওঠে।

সে নিজেই লিখেছিল রিপোর্টটা, কিন্তু তখনই ক্ষমতার চাপে কিছু করতে পারেনি।

সে ভাবে—“আমিও কি একটা মৃত্যুতে দায়ী?”

এভাবে একটার পর একটা স্মৃতি তাকে চেপে ধরে।

সৎ থেকে কিছুই করতে না পারার অসহায়তা, অপ্রাপ্তির হতাশা আর চারপাশের চুপচাপ সমাজ—সব মিলে সে প্রায় নিজেকে হারিয়ে ফেলে।

রাতের নিরবতায় আয়েশা আয়নার সামনে দাঁড়ায়, চোখে মুখে আর কোনো আত্মবিশ্বাস খুঁজে পায় না।

তার মনে হয়, সে একটা ‘বেরঙা ছায়া’ হয়ে গেছে।

তবুও ভেতরে কোথাও এক টুকরো জেদ বেঁচে থাকে।

সে বলে নিজেকে—

“তারা আমার পোশাক কেড়ে নিতে পারে, দায়িত্ব কেড়ে নিতে পারে… কিন্তু আমার সাহস কেড়ে নিতে পারবে না।”

এভাবেই, এক ভাঙা মানুষ আবার টুকরো জোড়া দিতে শুরু করে।

বহুদিন পর একদিন আয়েশা খবরের কাগজে পড়ে—

এক নারী গৃহকর্মী স্থানীয় চেয়ারম্যানের বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হয়ে থানায় অভিযোগ করতে গিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।


মেয়েটিকে দেখার জন্য সে নিজের পরিচয় ছাড়াই হাসপাতালে যায়।

চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি বলে,

— “আপনি পুলিশ? তাহলে তো কিছুই হবে না…”


এই কথাটি আয়েশার বুকের ভেতর আগুন ধরিয়ে দেয়।

সে সিদ্ধান্ত নেয়—যে দায়িত্ব সরকার দেয়নি, সেই দায়িত্ব এবার সে নিজে নেবে।


আস্তে আস্তে সে শুরু করে সামাজিক সহায়তা কার্যক্রম—

ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো

সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়া

মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ


তার ছোট ছোট পদক্ষেপে কিছু সাহসী মানুষ পাশে আসতে শুরু করে।

একটা লোকাল পত্রিকা তাকে নিয়ে শিরোনাম করে—

“নিঃশব্দ নায়িকা: নিষ্ক্রিয়তার মাঝেও সক্রিয় প্রতিবাদ”

কেউ কেউ বলতে শুরু করে—

“ও তো পুলিশ লাইনে! কিভাবে এখনো এত কাজ করছে?”

আয়েশা জানত, তার হাত বাঁধা, কিন্তু কণ্ঠ নয়।

সে ভেতরে থেকে সমাজে আলো ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে।


এটাই ছিল তার ক্ষুদ্র প্রতিবাদ—যা একদিন বড় হয়ে উঠবে বলে সে বিশ্বাস করেছিল।

বহুদিন পর একদিন আয়েশা খবরের কাগজে পড়ে—

এক নারী গৃহকর্মী স্থানীয় চেয়ারম্যানের বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হয়ে থানায় অভিযোগ করতে গিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

মেয়েটিকে দেখার জন্য সে নিজের পরিচয় ছাড়াই হাসপাতালে যায়।

চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটি বলে,

— “আপনি পুলিশ? তাহলে তো কিছুই হবে না…”

এই কথাটি আয়েশার বুকের ভেতর আগুন ধরিয়ে দেয়।

সে সিদ্ধান্ত নেয়—যে দায়িত্ব সরকার দেয়নি, সেই দায়িত্ব এবার সে নিজে নেবে।

আস্তে আস্তে সে শুরু করে সামাজিক সহায়তা কার্যক্রম—

ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানো

সাংবাদিকদের তথ্য দেওয়া

মানবাধিকার সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ

তার ছোট ছোট পদক্ষেপে কিছু সাহসী মানুষ পাশে আসতে শুরু করে।

একটা লোকাল পত্রিকা তাকে নিয়ে শিরোনাম করে—

“নিঃশব্দ নায়িকা: নিষ্ক্রিয়তার মাঝেও সক্রিয় প্রতিবাদ”

কেউ কেউ বলতে শুরু করে—

“ও তো পুলিশ লাইনে! কিভাবে এখনো এত কাজ করছে?”

আয়েশা জানত, তার হাত বাঁধা, কিন্তু কণ্ঠ নয়।

সে ভেতরে থেকে সমাজে আলো ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে।

এটাই ছিল তার ক্ষুদ্র প্রতিবাদ—যা একদিন বড় হয়ে উঠবে বলে সে বিশ্বাস করেছিল।

আয়েশার গল্প আর শুধুই এক ব্যক্তির লড়াই ছিল না, এটি হয়ে উঠেছিল একটি আন্দোলন।

সোশ্যাল মিডিয়া, সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার সহযোগিতায় সিস্টেমের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে এক আন্দোলন।

যদিও তার বিরুদ্ধে সরকারীভাবে এখনও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ হয়নি, তবে একটি বৃহত্তর আলোচনা শুরু হয়।

আয়েশা আর তার মতো অনেকেই একে একে সাহসী হতে শুরু করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য—

যতটা ভয় ছিল, ততটাই শক্তি পাওয়া যায়।

কিছুদিন পর একটি নতুন কমিশন গঠন করা হয়—এটা ছিল তার সংগ্রামের ফল।

আয়েশা সেই কমিশনের একটি সদস্য হিসেবে যুক্ত হয়, এবং শুরু হয় সমাজে আরও বড় পরিবর্তন আনার পথ।

সে জানত—এই পরিবর্তন একদিন হবে, যদি সবাই একসাথে দাঁড়িয়ে যায়।

এবং সেই দিনের জন্য সে প্রস্তুত ছিল, যেখানে সত্যের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা হবে, এবং ক্ষমতার অপব্যবহার আর সহ্য করা হবে না।

তবে, একটাই কথা মনে রেখে—

“এটাই শুরু। শেষের আগে কিছুই শেষ হয় না।”

আয়েশা নিজের পুরনো থানা ভবনে ফিরে যায় একদিন।

এখন আর সে নির্বাসিত নয়, আর কেউ তাকে ‘একা’ বলে না।

সে জানে, আগামী দিনের জন্য আরও অনেক কাজ বাকি।

তবে এই একসাথে চলা শুরু হয়, একসাথে মানবতার পথ খোঁজা হয়—এটাই ছিল তার জয়।

এভাবেই শেষ হলো নীরব প্রতিবাদ। আশা করি এই বইয়ের কাহিনী আপনাকে ভালো লেগেছে।

যদি কোনো সংশোধন বা আরও কোনো অংশ যোগ করতে চান, জানিয়ে দেবেন!


No comments:

Post a Comment

বাস্তব জীবনের গল্প।

                         “স্বপ্নের শহর নিউইয়র্ক”                                  " আয়েশা সিদ্দীকা " ২৬ ডিসেম্বর ২০২১। ঠান্ডা শ...